মনির হোসেন
আধুনিক মানুষের সমস্ত সৃজনীশক্তির মধ্যে উৎকর্ষ হল আইন তৈরি। গুহাবাসী মানুষ সমাজবদ্ধ হবার পরপরই পশু পালন ও উদ্যান-কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্ত হয়। উৎপাদিত ফসল বণ্টন ও ভোগের নিমিত্তে নিজেরা নিজেরা সমাজকে শৃঙ্খল ও সুসংহত করতে তৈরি করতে শিখেছে আইন। যার প্রভাবে ছিল পূর্ব-পুরুষদের বিশ্বাস, প্রথা ও আচার- আচরণের রীতি-নীতি। আবার স্থান পরিবর্তন ও প্রচলিত উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে আইন ও সামাজিক মূল্যবোধও পরিবর্তন ও বিবর্তিত হয়েছে। পূর্বের এই সমাজ পরিবর্তনরীতি এখনো গতিশীল। সেইজন্য আইনের গূঢ়ার্থ প্রত্যয়ে বলা হয়-“আইন তৈরিই হয় আইন ভাঙার জন্য। নতুন আইন তৈরি করার জন্য”। আজকের আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে নতুনত্ব পরিস্থিতি, সময় ও মানুষের প্রয়োজনে আইন ভেঙে নতুন আইন সৃজন; আধুনিক মানুষের সর্বোচ্চ নৈতিক কর্মগুণ। লেনিনের ভাষায়-” রাষ্ট্র মানেই অমীমাংসিত বিষয়। শ্রেণিকরণের ধাপ।” কাজেই রাষ্ট্র মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনের নিমিত্তে সৃষ্টি। তাই কোনো দেশের সংবিধান সেই দেশের সর্বোচ্চ আইনি কাঠামোর চিরস্থায়ী কোনো বস্তু নয়। এমনকি তা ওহী প্রেরিত না যে, আইন-সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে না। কাজেই রাষ্ট্র, সমাজ যেহেতু অপরিহার্যরূপে পরিবর্তনশীল; তাই দেশের সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতি প্রভৃতিও সংস্কার ও পরিবর্তনযোগ্য। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের স্বার্থে নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, সংবিধানে নতুন ধারা সংযুক্তকরণ ও সংশোধন আবশ্যক।
১.
বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকত্ব ধারার অনুচ্ছেদ ৬ (২) বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন (বাংলাদেশ সংবিধান)”। কিন্তু বাংলাদেশে তো কেবল বাঙালি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে না। এখানে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতিসত্ত্বার মানুষ বসবাস করে। তাছাড়া যে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে এই বাঙালি জাতিগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে প্রাচীন অস্ট্রিক জাতির সংমিশ্রণে। যে অস্ট্রিক বা নিষাদ (সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, দ্রাবিড়, ভোটচেনীয় এবং অন্যান্য) জাতির লোকেরা বাঙালি জাতিরও পূর্বে প্রাচীন কাল থেকে বঙ্গ জনপদে বসবাস করতেন। তারাই আজকের বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষ। আবার বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ প্রায় পঞ্চাশটি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু তাদেরকে বাদ দিয়ে সংবিধানে শুধু বাঙালি জাতিকে স্বীকৃতি দেওয়া তাদের প্রতি সাংবিধানিক “স্বীকৃতিগত বৈষম্য”। অবিলম্বে এ সমস্ত জাতিসত্ত্বাগুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিগত বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পেতে সংবিধানে মর্যাদা সম্পন্ন স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই যাদের আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি বলি তারা আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে জোর দাবি জানিয়ে আসছে।
২.
সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকারে বলা হয়েছে-“রাষ্ট্রপতি কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত রায়, মুত্যুদণ্ড, মার্জনা, মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে”। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচার বিভাগে (কাগজে কলমে স্বাধীন) ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বলয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কোনোভাবেই নিরপেক্ষ হতে পারেন না। দলীয় ব্যক্তি মানুষ কখনো নিরপেক্ষ হয় না; তাকে পক্ষ অবলম্বন করতেই হয়। যদিও আমাদের সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সমস্ত কর্ম, নির্বাহী কার্যাবলী রাষ্ট্রপতির নামে পরিচালিত হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্রে তাঁর এখতিয়ার খুবই কম। বলা চলে দৃশ্যমান পুতুল ছাড়া আর কিছু না। ফলে রাষ্ট্রপতি প্রকৃতপক্ষে পরিচালিত হোন সংসদ নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী ইশারা ইঙ্গিতের অনুকূলে। সেজন্য ক্ষমা প্রদর্শনের এই ৪৯ নং ধারা সংশোধন করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে তা পুরোপুরি স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ নিশ্চিত করণের ভিত্তিতে বিচারপতিদের এখতিয়ারে দেওয়া উচিত। কারণ রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত এই সাংবিধানিক ধারাকে অপব্যবহার করে পূর্বে আওয়ামী লীগ, বিএনপি জোট সরকার তাঁরা তাঁদের দলীয় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ শান্তি ও মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস করে নিয়েছে। যেমন। “২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় ফৌজদারি মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ৩০ কয়েদি ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই পেয়েছে। তাদের মধ্যে ২৩ জনকে পুরোপুরি খালাস দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে ২০০৯ সালে একজন, ২০১০ সালে ২১ জন, ২০১১ সালে তিনজন, ২০১২ সালে তিনজন ফাঁসির আসামি রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা পায়। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ক্ষমা পেয়েছে দুজন ফাঁসির আসামি (কালের কণ্ঠ, ৬ মার্চ, ২০১৪)”। পরিসংখ্যান এখানেই শেষ নয়, আরো আছে। এই অনুচ্ছেদের ফলে বিচার বিভাগ থেকে ন্যায় বিচার পাবার ক্ষেত্রেও জনগণের আস্থা নাজুক। যার অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, দলীয় কর্তৃত্ব থাকবে সে কোনো না কোনোভাবে অন্যায় করেও রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতার বদৌলতে পার পেয়ে যেতে পারে। অবিলম্বে এই অনুচ্ছেদে বাতিল যোগ্য।
৩.
বাংলাদেশের সংবিধান গঠনগতভাবে একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার সৃষ্টির জন্যে উন্মুক্ত। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার বয়সের লিমিট আছে কিন্তু কতবার হওয়া যাবে তার কোনো সময়সীমা নির্ধারণ নেই। ফলে দেখা যায় যে একবার প্রধানমন্ত্রী, এমপি হোন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (বিশেষ কিছু না হলে) তিনি অধিষ্ঠিত থাকেন। এ লাগাম আমাদেরকে টেনে ধরতে হবে। সংবিধান সংস্কার করে কেউ যেন দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী ও তিন বারের বেশি এমপি পদে থাকতে পারবে না এমন সাংবিধানিক ধারা সংযুক্ত করতে হবে। এবং জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে কমপক্ষে বিএ পাশ থাকা এই আইনিক ধারা সংযুক্ত করতে হবে। এতে করে নতুন নেতৃত্ব যেমন ওঠে আসবে সেই সাথে দলীয় কাঠামোর মধ্যে প্রজ্ঞাবান, শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। ফলাফলস্বরূপ জাতীয় রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র, রাজনীতিকে ব্যবসা, রুটি ও রুজির কারখানা বানানো দ্রুতই বন্ধ করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত অনেক রাষ্ট্র এই নিয়ম জারি আছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো বাংলাদেশে বৈষম্য নিরসণে প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি ব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রথমত, একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত হবেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট। এ পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে (দলীয় ব্যবস্থায় সরকার গঠন) অন্যটি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা প্রফেশনাল রিপ্রেজেনটেশন সিস্টেম (কার্যত বিভিন্ন দলের অর্জিত শতাংশ ভোটে মিলিত সরকার গঠন) অর্থাৎ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। এ পদ্ধতি হলো একটি দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে শতাংশ নির্ধারণ করে সংসদে দলটির প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ হবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩০০ তে সরাসরি ভোট হয়। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে প্রতি ১ শতাংশ ভোটের জন্য তিনটি আসন পাওয়া যাবে। যে দল ৫০ শতাংশ ভোট পাবে, তারা সংসদে আসন পাবে ১৫০টি। সাম্প্রতিক সময়ে আসনও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আরেকটি দিক হলো এই পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে কোনো দলের প্রার্থী থাকবে না, থাকবে প্রতীক বরাদ্দ। মানুষ ভোট প্রদান করবে প্রতীকে: কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনিত ব্যক্তিকে নয়। কত শতাংশ ভোট পেয়েছে তার উপর ভিত্তি করে নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক দলসমূহ তার দলের ভেতর ইমেজ সম্পন্ন ব্যক্তিদের সংসদে প্রেরণ করবে। রাজনীতির ময়দানে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করবে, তারা তাদের নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বলা হয় রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রে সর্বত্র জনগোষ্ঠীর, সর্বজনের অংশগ্রহণ থাকে কিন্তু গণতন্ত্রে বাংলাদেশে নির্বাচন কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বজনীন অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় না। যা আছে তা হলো নির্বাচিত দলের একক ক্ষমতা যা নিদেনপক্ষে দলীয় স্বৈরাচারের অংশগ্রহণ। স্বাধীনতা পরবর্তী গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র দ্বি-দলীয় পারিবারিক শাসনের বৃত্তে আটকা পড়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে এককেন্দ্রীকরণ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক পারিবারিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন দেখেছে দেশের মানুষ। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশে বিতর্কিত সব নির্বাচন ছাড়া যে দল বা জোটই সরকার গঠন করেছে কিনা, তাদের কেউই এখন পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশর বেশি ভোট পেয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। অন্যদিকে রাষ্ট্রে বিগত সময়ে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ যারা ভোট দিয়েছে নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে ও সরকারে তাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন আশানুরূপ ঘটেনি। অর্থাৎ যারা ভোট প্রদান করেছে কিন্তু তাদের প্রতিনিধি কম সংখ্যক ভোট পাবার কারণে ভোটারদের প্রদত্ত ভোট বিফলে গিয়েছে। তাই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে শত সম্ভাবনা আছে। কারণ নির্বাচনে সংসদে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু করা গেলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এই দ্বি-দলীয়বৃত্ত পরিবার ও প্রচলিত দলীয় স্বৈরাচার পদ্ধতি থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে। আর তাতে করে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, স্ব-স্ব শ্রেণি ও তাদের রাজনৈতিক মেনিফেস্টো বাস্তবায়নে জাতীয় বিকাশে ও উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারবে। বিগত সময়ে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে দলীয় মনোনয়ন পেতে নির্বাচন করতে আগ্রহী ব্যক্তিদের অর্থ প্রদান, অনুগত তেলবাজ, পেশি শক্তির ব্যবহারের অহরহ ঘটনা। নির্বাচনের মাঠে প্রার্থীকে জেতাতে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোট কেনার মতো উদাহরণও কম নয়। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন এক এমপি ভোটের সময় তার এলাকায় বিরোধী দলের প্রার্থীর সাথে যখন ইমেজ সংকটে পরাজিত হচ্ছিলেন তখন তিনি দাম্ভিকতার সুরে বলেছিলেন “বটপাতা ছড়ালে ছাগলের অভাব হয় না”। অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে জনগণকে বুঝাতে চেয়েছিলেন টাকা দিলে ভোট এমনতিতেই চলে আসে। টাকা দিয়ে ভোট কেনা অসম্ভব কিছু না। বিদ্যমান কাঠামোতে এক দলীয় স্বৈরাচার যাবে, আরেক স্বৈরাচার আসবে। সিস্টেম প্রথা স্বৈরাচার নিয়ে আসতে বাধ্য করবে। তাই দলীয় স্বৈরাচার, পারিবারিক গণতন্ত্র, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরিতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতিতে এক অংশকে উপেক্ষা করে অন্য অংশের উন্নয়ন এই বৈষম্যরোধ করা অনেকটাই সম্ভব হবে। গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় তার বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত হবে কিছুটা হলেও।
লেখক,মনির হোসেন,শিক্ষক ও গবেষক (বাংলা)
ইংরেজি বিভাগ বাংলাদেশ ব্যবসা ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(বিইউবিটি।