বরেন্দ্র বার্তা-২৪ডেস্ক নিউজ :
বিখ্যাত অধ্যাপক রওনক জাহান তার লেখা “Bangladesh in 1972: Nation Building in a New State”-এ বলেছিলেন একটি সুসংহত রাষ্ট্র গঠনের জন্য দুইটি উপাদানের একই সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো অত্যবশ্যকীয়- ১. জাতি গঠন ও ২. রাষ্ট্র গঠন। জাতি গঠন মানে একটা ইনক্লুসিভ রাষ্টীয় পরিচয় (inclusive state identity) তৈরি করা। এই রাষ্ট্রীয় পরিচয় তৈরি করার মূল লক্ষ্য হলো জাতীয় ঐক্য তৈরি করা।
যে পরিচয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সমস্ত জনগণ একটি একক সত্তায় পরিণত হয়। এই একক জাতীয় পরিচয় দেশপ্রেমের অন্যতম ভিত্তি। যে দেশের জাতি গঠনের প্রক্রিয়া যত মজবুত সেই দেশের জনগণ তত বেশি একক সুরে কথা বলবে- যখন রাষ্ট্র কোনো ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যায়। আর রাষ্ট্র গঠন মানে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে তিনটি অঙ্গ সংস্থা – ১. শাসন বিভাগ, ২. আইন বিভাগ ও ৩. বিচার বিভাগ।
এই তিনটি সংস্থাকে দক্ষ, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করতে আরও অনেক দক্ষ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দরকার। যেমন- দক্ষ পাবলিক সার্ভিস, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, মঞ্জুরি কমিশন, ন্যায়পাল ও মানবধিকার কমিশন ইত্যাদি। দক্ষ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে একটি দেশে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন তৈরি করা সম্ভব হয়।
এ যাবতকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ শাসকগণ স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়াতে কখনই কোনো গুরুত্বই প্রদান করেননি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে শাসকগোষ্ঠীর অধিক পরিমাণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো একবারেই ভঙ্গুর অবস্থায় বিরাজমান ছিল । অধিকন্তু বিগত স্বৈরসরকার নিজ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণরূপে খোঁড়া করে দিয়েছে। এই জাতি পাকিস্তান আমলে ২৪ বছর আন্দোলন করেছে ও রক্ত ঝরিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য।
স্বাধীনতার পর ক্রমান্বয়ে আরা অনেকবার রক্ত ঝরিয়েছে সেই গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য এবং আমরা সবাই অবহিত বাংলাদেশে ৯০-এর গণঅভুত্থানের পরে যদিও ভোটের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু যেহেতু সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়তে ব্যর্থ হয়, তাই প্রতিটি সরকার তাদের মেয়াদের বাইরে গিয়ে অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল। সেই ইতিহাস আশা করি জাতি ভুলে যায়নি। অধিকন্তু গত ১৪ বছর ধরে জাতি সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছে তাদের ভোটের আধিকার। বিগত সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণরূপে কুক্ষিগত করে জনগণকে নিষ্পেষিত ও শোষণ করেছে বিভিন্নভাবে।
এখন যদি রাষ্ট্র গঠনের সাথে জাতি গঠনকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে জাতি গঠন প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছে আপাতদৃষ্টিতে; যা স্টুডেন্ট আন্দোলন ২০২৪ ও তার প্রতি অধিকাংশ জনগণের সংযুক্তি দ্বারা যে গণঅভুত্থানের সৃষ্টি হয়েছে; যা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে তা দ্বারা প্রতীয়মান হয়। কিন্তু আগেই বলেছি জাতি গঠন প্রক্রিয়া পরিপূর্ণতা পাবে না যদি না রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া পরিপূর্ণতা পায়; যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখছি যদিও হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা ও নানাবিধ অরাজকতার বিরাজমান রয়েছে।
সদ্যগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। তার জন্য জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক ভোটের ব্যবস্থা করে একটি নির্বাচিত সরকারে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তার করা এই সরকারে অন্যতম দায়িত্বকের মধ্যে পড়ে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে দাবি করেছে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে।
এমত অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাড়াহুড়া করে নি:সন্দেহে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন। যেমন ৯০-এর নির্বাচনের প্রকৃত উদাহরণ হতে পারে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সুসংহত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া সেই নিরপক্ষ নির্বাচন কোনোভাবেই তিনটি অত্যাবশ্যকীয় রাষ্ট্রীয় অঙ্গ সংস্থা তৈরি করতে পারবে না। নেট ফলাফল হবে যে স্বৈরশাসন বাংলাদেশর জনগণ স্বাধীনতার পর থেকে এবং বিশেষত গত ১৪ বছর যাবত যে দু:শাসনের ফলাফল ভোগ করে আসছে তা বারবার ফিরে আসবে ও আবার ভোগ করবে। তাহলে দেশের ও মানুষের মুক্তি কোথায়?
যে কারণে বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি তার মূল কারণ হচ্ছে দক্ষ, সুচারু, কৌশলী জ্ঞানী, ভিশনারি ও সর্বোপরি দেশপ্রেমিক নেতা-নেতাদের অভাব। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তা জাতির জন্য নিশ্চিতভাবে আশার আলো বহন করছে। এযাবতকালে অধ্যাপক ইউনূসের প্রজ্ঞা, দৃঢ়তার, ভিশন ও জ্ঞান অভিভূত করেছে দেশে ও বিদেশের অনেককেই । অধ্যাপক ইউনূস ছাড়া অন্যান্য সদস্যরা যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশ তারাও নিজ নিজ জায়গায় স্বনামধন্য।
এই ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা তাদের হিতৈষী কর্মের জন্যও সমাদৃত হয়েছেন, বিগত ২০ বছর ও তার অধিক সময় ধরে এই সদ্য গঠিত সরকারের সদস্যদের প্রায় সবারই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের সততা বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এ সরকারে ছাত্রছাত্রী সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে, যারা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যাদের প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, ত্যাগ, সততা ও দৃঢ়তা সমগ্র জাতিকে অভিভূত ও একত্রিত করেছে। এছাডা সরকারের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে ।
বাংলাদেশের আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। যেভাবে সরকারের সদস্য বাছাই করা হয়েছে তা দেশের মূল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় সামগ্রিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই সরকারের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যাদের রাজনৈতিক কোনো দলের সাথে সংযুক্ততা নেই তাদের ব্যাপক আস্থা আছে বলে মনে হয়। উপরের সব কিছু বিবেচনায় এনে আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ ভালো কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
কিন্তু এই সরকারের কাছ থেকে জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু তা জনগণকেই বিবেচনা করতে হবে। তারা কি শুধু খণ্ডকালীন ভোটের অধিকার চায় যেটা টেকসই হতে পারবে না অন্যান্য শক্তিশালী ও সুসংহত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির অভাবে। নাকি এই সরকারের প্রতি জনগণের প্রাত্যাশা থাকবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করার মূল কিছু অবকাঠামো তৈরি করা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি একটি সময়সাপেক্ষ কাজ, যা স্বল্পমেয়াদি সরকার দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ বর্তমানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে ভঙ্গুর অবস্থায় বিরাজমান আছে তা মেরামতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু রিফর্ম-পুন:গঠনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
অধ্যাপক ইউনূস ও তার নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তারা ভীষণ দক্ষ, অভিজ্ঞ ও কৌশলী। জনগণ নি:সন্দেহে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন। কিভাবে নতুন সরকার জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে সমন্বয় করবে ও কতটুকু সফল হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে জনগণের সহযোগিতা, আস্থা ও ধৈর্যের মাধ্যমে। একই সঙ্গে ভীষণভাবে নির্ভর করে কিভাবে নতুন সরকার অধিকাংশ জনগণকে আস্থায় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতি যেমন পৃথিবীর বুকে মাইক্রো ক্রেডিটের জন্য স্বনামধন্য হয়েছেন, তেমনিভাবে আমরা দৃঢপ্রত্যয়ের সঙ্গে প্রত্যাশা করি তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে সমাদৃত হবে পৃথিবীর বুকে। জাতি তার মতো মহান ব্যক্তির হাত ধরে তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রকৃত পথ খুঁজে পাবে।