
ড. মো. আমিরুল ইসলাম
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি নিরপেক্ষ, কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সংস্কার গণতন্ত্রকে টেকসই করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
১. সাংবিধানিক সংস্কার,(ক) নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ,সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের (EC) নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা।কমিশনকে সরকারের প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সাংবিধানিক ক্ষমতা দেওয়া।কমিশনের বাজেট স্বায়ত্তশাসিত করা, যাতে তারা রাজনৈতিক চাপে না পড়ে।
(খ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো নির্ধারণ১৯৯৬ সালের ১৩তম সংশোধনীর মতো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধি সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা।
(গ) সংসদীয় সংস্কার সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে দলীয় প্রধানদের একক কর্তৃত্ব কমানো।
কেউ দুইবারের বেশি দলীয় প্রধান বা সরকার প্রধান হতে পারবেন না।সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের দলীয় হুইপের বাইরে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া।
২. রাজনৈতিক সংস্কার (ক) রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা
দলীয় প্রধানদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা।
অভ্যন্তরীণ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করা ও মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা।(খ) সহিংসতা ও দমননীতি বন্ধ করা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ করতে সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিত করা।দলীয় ক্যাডার নির্ভরতা কমিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার
(ক) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করা।
পুলিশ ও প্রশাসনের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করে নিরপেক্ষ নীতিমালা প্রণয়ন করা।
(খ) মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮) বাতিল বা সংশোধন করা, যাতে এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করতে না পারে।
গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা প্রদান করা।
৪. নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার (ক) ভোটারদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা বায়োমেট্রিক ভোটিং ও পেপার ব্যালটের সমন্বিত ব্যবস্থা চালু করা।
ভোটের দিন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা, যাতে ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাতিল করা, যাতে স্থানীয় নেতৃত্ব দলীয় রাজনীতির চাপে না পড়ে।(খ) নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ করা
নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ ও তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
অবৈধ উপায়ে প্রভাব বিস্তারকারীদের প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রাখা।
৫. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও কূটনৈতিক উদ্যোগ,জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেওয়া।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ করা।
এই সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও ছাত্র-উপদেষ্টা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Email: pkkanak@ru.ac.bd