ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দুর্দশা ও বিলুপ্তি: ওয়াহাবি-সৌদ পরিবারের দায়

ড. মো. আমিরুল ইসলাম কনক,

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বর্তমান দুর্দশা ও সম্ভাব্য বিলুপ্তির প্রশ্নে যদি প্রকৃত দায়ীদের খোঁজা হয়, তবে ওয়াহাবি মতাদর্শ এবং সৌদি রাজপরিবারের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা চলে না। যদিও বিষয়টি রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর, তবুও ইতিহাস, আদর্শ, এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থের নিরিখে বিশ্লেষণ করলে এক নির্মম সত্য বেরিয়ে আসে: ফিলিস্তিনিদের পিঠে ছুরি বসানোর অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল ইসলামের নামে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এই গোষ্ঠীটি।

ইতিহাসের পাতায় ওয়াহাবি মতবাদ

১৮শ শতকে আবির্ভূত ওয়াহাবি মতবাদ ইসলামের একরকম কট্টর পুনর্জাগরণবাদী সংস্করণ, যা ধর্মীয় সহনশীলতা এবং মতবৈচিত্র্যের বিপরীতে অবস্থান নেয়। শিয়া, সুফি কিংবা অন্যান্য ইসলামি ধারার প্রতি শত্রুতা ছিল এর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। এই মতাদর্শ ইবনে সৌদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার বিনিময়ে ধর্মীয় বৈধতা দেয় এবং এভাবেই সৌদি রাজতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে ওঠে। সেই থেকে ধর্ম ও রাজনীতির এই অদ্ভুত সমন্বয় ইসলামের নামে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

ফিলিস্তিন প্রশ্নে সৌদি দ্বিচারিতা

ফিলিস্তিন সংকট শুরুর পর থেকে সৌদি আরব মুখে মুসলিম উম্মাহর পক্ষ নেয়, কিন্তু বাস্তবতায় তারা ছিল একেবারেই নিষ্ক্রিয়।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে সৌদি আরব সামরিক সহায়তায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাই ছিল তাদের অগ্রাধিকার।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধেও তারা সামান্য অর্থনৈতিক সহায়তার বাইরে কিছু করেনি।
এরপর সময় গড়িয়েছে, কিন্তু পরিবর্তন আসেনি।

তাদের আরেকটি কৌশল ছিল ফিলিস্তিনি আন্দোলনের অভ্যন্তরে বিভক্তি তৈরি করা। ইসলামপন্থী দলগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তারা একদিকে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছে, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছে। পিএলও’র মতো সংগঠনগুলো সবসময় ওয়াহাবি আদর্শের কাছে “অবাঞ্ছিত” ছিল।

নতুন যুগে পুরোনো ধারা

সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো দেয়নি, তবুও ব্যাকচ্যানেল কূটনীতি, গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে একপ্রকার অঘোষিত মিত্রতায় পৌঁছে গেছে দুই রাষ্ট্র।
আব্রাহাম অ্যাকর্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও সৌদির মৌন সমর্থন ছিল স্পষ্ট। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও সৌদি রাজতন্ত্র পিছন থেকে কাজ করেছে।

একটি রাষ্ট্রের বিলুপ্তি, একটি জাতির আত্মবিস্মৃতি

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আজ বিচ্ছিন্ন, ভঙ্গুর এবং প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই পরিণতির পেছনে সৌদি রাজপরিবারের কূটকৌশল, ওয়াহাবি মতাদর্শের বিভাজনমূলক প্রভাব, এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদানের ব্যর্থতা মূল কারণ। সৌদি আরব ইসলামের নামে রাজতন্ত্র রক্ষা এবং পশ্চিমাদের সমর্থন আদায়ের কৌশলে ফিলিস্তিনিদের বারবার বিসর্জন দিয়েছে।

একটি জাতির অস্তিত্ব যখন রাজনৈতিক স্বার্থে বলি হয়, তখন শুধু রাষ্ট্র নয়, মানবতারও এক পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ের দায় ওয়াহাবি-সৌদি জোট কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

 লেখক-ছাত্র-উপদেষ্টা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *