ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতির জন্য ভারত নিজেই দায়ী

ড. মোঃ আমিরুল ইসলাম

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বর্তমানে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা মূলত ভারতের একতরফা নীতির কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ও তার মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের প্রোপাগান্ডা, মিডিয়া সন্ত্রাস, এবং বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী নীতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ভারতের উচিত ছিল কেবল আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর না করে, বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখা। কিন্তু ভারতের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও একতরফা কৌশলগত অবস্থান এই সম্পর্কে দূরত্ব বাড়িয়েছে।

ভারত কেন এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী?

১. দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্থিতিশীলতা রক্ষায় ব্যর্থতা,দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য ভারতের উচিত ছিল বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। কিন্তু ভারত কেবল আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করেছে, যা ভবিষ্যতে বিপজ্জনক হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকার পরিবর্তন হলে, যদি বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, তবে ভারতের প্রতি তাদের মনোভাব শত্রুতাপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, তারা মনে করতে পারে ভারত সবসময় একপক্ষীয় নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

২. জনগণের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থতা,
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবের একটি বড় কারণ হলো সাধারণ মানুষ মনে করে ভারত কেবল একটি দলকে (আওয়ামী লীগ) সমর্থন দেয় এবং অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে উপেক্ষা করে। অথচ, ভারতের উচিত ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষা ও জনগণস্তরের যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ভারত তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেবল ক্ষমতাসীন দলের ওপর নির্ভর করেছে, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও তীব্র করেছে।

৩. দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থতা,
ভারত যদি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, তবে বাংলাদেশের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোও দলীয় প্রভাবিত হয়ে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ভারতের স্বার্থও বিপন্ন হতে পারে। যদি ভারত সব রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করত, তাহলে যেকোনো সরকার ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ভারতের স্বার্থ নিশ্চিত থাকত। কিন্তু ভারত তা করেনি, বরং একপক্ষীয় কূটনীতি অনুসরণ করেছে, যা ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

৪. আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ব্যর্থতা, বর্তমানে বাংলাদেশে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব বাড়ছে। ভারত যদি কেবল আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল না থাকত এবং বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখত, তাহলে চীন বা অন্য শক্তিগুলো কেবল বিএনপি বা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ভারসাম্য বদলে দিতে পারত না। কিন্তু ভারতের একপক্ষীয় কৌশল চীনের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার সহজ করে দিয়েছে, যা আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যে ভারতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৫. গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি রক্ষায় ব্যর্থতা,
যদি ভারত কেবল একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন না দিয়ে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখত, তাহলে এটি ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির জন্যও ইতিবাচক হতো। কিন্তু ভারত বরাবরই একতরফা নীতি অনুসরণ করেছে, যা তাদের ‘বৃহত্তর গণতান্ত্রিক শক্তি’ হিসেবে পরিচিতি নষ্ট করেছে। ফলে, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান অবনতি মূলত ভারতের একতরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতির ফলাফল। ভারতের উচিত ছিল বাংলাদেশে কেবল আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্থিতিশীলতা, জনগণের আস্থা অর্জন, দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ রক্ষা, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য বজায় রাখা এবং গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভারতের যে ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা ভবিষ্যতে তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভারত যদি এখনো বাংলাদেশে একটি সমন্বিত ও সর্বজনীন কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ না করে, তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও সংকটের দিকে ধাবিত হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও ছাত্র-উপদেষ্টা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *